Voice of SYLHET | logo

১০ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ২৫শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং

সবকিছু খুলে দিয়ে ঢাকা যেন নিউ ইয়র্ক না হয়

প্রকাশিত : May 06, 2020, 23:16

সবকিছু খুলে দিয়ে ঢাকা যেন নিউ ইয়র্ক না হয়

নিউজ ডেস্ক:-

প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল প্রসঙ্গে ’৭০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম নেতাদের এক মিটিংয়ে কথা উঠেছিল, ‘আমরা আমাদের ভূমি দখল করতে চাই; না, আমাদের মানুষকে জীবন বাঁচাতে চাই?’—এটা আগে ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের সামনেও এখন বড় প্রশ্ন, আমরা এ মুহূর্তে অর্থনীতির চাকা সচল করতে চাই; না, আমাদের মানুষের জীবন বাঁচাতে চাই? সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এটা নিয়ে সরকার দ্বিধায় ভুগছে। কারণ, একদিকে শপিং মল খুলে দেওয়া হচ্ছে অন্যদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, এভাবে সবকিছু খুলে গেলে করোনা বাড়বেই। এই লেখা যখন লিখছি তখন করোনা সংক্রমণ প্রায় প্রতিদিনে হাজার ছুঁতে চলেছে। এবং করোনা সংক্রমণের এই লাফ শুরু হয়েছে গার্মেন্টস খুলে দেওয়ার পর থেকে। এখন শপিং মল খুললে, সারা দেশে বাজার খুললেএই লাফ যদি জ্যামিতিক হারে বাড়ে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমেরিকা, স্পেন, ইতালি সব জায়গাতেই জ্যামিতিক হারে এই লাফ এগিয়েছে। তাই এ নিয়ে আমাদের ভুল করার কোনও সুযোগ নেই। কারণ, চীন ও ইউরোপ এ দুটোর উদাহরণ আমাদের সামনে। পাশাপাশি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কোন পথে সাফল্য পেয়েছে, সেটাও দেখার সুযোগ পাওয়া গেছে। দুটো ব্যর্থতা এবং একটি সাফল্য’র উদাহরণ সামনে থাকতে সরকারের এই দ্বিধায় ভোগার কারণ কী? চীনে বিস্তার বেশি হয়েছিল ও মানুষ বেশি মারা গেছে, কারণ তারা লকডাউন করতে দেরি করেছিল। আমেরিকা, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি দেশ আরও বেশি মানুষ মারা গেছে লকডাউন যেমন দেরিতে করেছে, তেমনি কঠোর লকডাউনে যেতে পারেনি। অন্যদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সাফল্য এসেছে কঠোর লকডাউনের কারণে।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই সাফল্য দেখার পরেও আমাদের এই লকডাউন কঠোর করা নিয়ে কেন সরকার দ্বিধায় ভুগছে? অর্থনীতির চাকা সচল আগে না মানুষের জীবন বাঁচানো আগে, এ নিয়েও বা কেন দ্বিধা আসছে? করোনা নিয়ে সরকারের আচরণ দেখে কখনও কখনও মনে হচ্ছে সরকার কি আসলে কারও চাপের কাছে নত হচ্ছে? ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা তো কারও চাপের কাছে নত হওয়ার জন্য জন্ম নেননি। তাহলে তার হাতেই যখন শতাব্দীর এসবভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারি থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব পড়েছে, সে সময়ে কেন তার সরকারের ভেতর এই দ্বিধান্বিত আচরণ! প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. আবদুল্লাহ বলেছেন, তিনি মতামত দিয়েছিলেন ৫ মে অবধি গার্মেন্টস না খুলতে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কেউই মনে হয় সরকারকে এ পরামর্শ দেননি যে গার্মেন্টস খুলে দেন। কিন্তু বাস্তবে এই গার্মেন্টস নিয়ে করোনাকালে কী না ঘটে গেলো! একবার যখন শ্রমিকদেরমাইলের পর মাইল পথ হাঁটিয়ে ঢাকায় এনে আবার ফিরে যেতে বলা হলো তখন গার্মেন্টস মালিক অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রুবানা হককে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি কেন এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, তিনি বলির পাঁঠা। তার সমর্থনে কিছু ডকুমেন্টসও দিলেন। ভেবেছিলাম এর পরে গার্মেন্টস মালিকরা আর এগুবেন না। কিন্তু পরে দেখা গেলো তাদের চাপে সরকার গার্মেন্টস খুলে দিতে বাধ্য হলেন। আর তারা এই পথ করে দেওয়ার পরে একের পর এক ব্যবসায়ীগোষ্ঠী নানান উছিলায় কথা তুলছেন দেশের অর্থনীতি রক্ষা করার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবন শেষ করে সমাজবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক এখন শহরতলীতে নিরিবিলি বাস করছেন। সাধারণত কোনও রাজনীতির ঝক্কিতে তিনি যেতে চান না। অথচ তার মতো ব্যক্তি এই শপিং মল খোলার সিদ্ধান্ত দেখে ফোন করে বললেন, ব্যবসায়ীরা ঈদে ষাট হাজার কোটি টাকার মালামাল বিক্রি করতে চায় বলে, তাদের চাপে সরকার দেশের মানুষকে এই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছে। যখন করোনা সংক্রমণ প্রতিদিন লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়ছে, এই সময়ে শপিংমল খুললে তো ঢাকার অবস্থা নিউ ইয়র্কের মতো হয়ে যাবে। তিনি বললেন, এই ব্যবসায়ীদের কথা শোনার কোনও দরকার নেই শেখ হাসিনার। কারণ, তারা দেশের অর্থনীতি রক্ষা করবে না। বরং তারা সুযোগ পেলে আবার দেশের টাকা বিদেশে পাচার করবে। দেশের অর্থনীতি শেখ হাসিনাই রক্ষা করবেন। তিনি যে অর্থনীতির প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, ওই প্যাকেজই দেশের অর্থনীতি রক্ষা করবে।ওই প্যাকেজের সঙ্গে তার পক্ষে আর দশ হাজার কোটি টাকা দেওয়া কোনও বিষয়  নয়। আর দশ হাজার কোটি টাকা দিলে দেশের মানুষকে দিব্যি এক মাস নয় কয়েক মাস ভালোভাবে খাইয়ে  পরিয়ে রাখতে পারবেন। দেশের মানুষও অকৃতজ্ঞ নয়, তারাও শেখ হাসিনাকে মনে রাখবে। তবে সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তার বক্তব্য হলো, আমাদের দেশের মানুষের চরিত্রে আইন মানার স্বভাব কম। তাই অন্তত পনেরো থেকে বিশটি দিন কঠোরভাবে ঘরে রাখার জন্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মতো কঠোর হতে হবে।
একজন প্রবীণ প্রগতিশীল রাজনীতিকের বক্তব্যও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতো। তিনি বললেন, দেখেন এই গার্মেন্টস মালিকরা করোনার ভেতর প্রতিষ্ঠান খুলে রাখার বিষয়টি শুরু করেছে। তারা দেশের মানুষের মৃত্যুর দিকে তাকাচ্ছে না, তারা তাকাচ্ছে তাদের লাভের দিকে। শেখ হাসিনা প্রথমেই তাদের পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছেন। শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য প্রণোদনা। তারপরেও তারা সরকারকে চাপ দিয়ে গার্মেন্টস খোলার ব্যবস্থা করলো। এখন আবার বলছে তারা ষাট ভাগ বেতন দেবে। শতভাগ বেতন দেবে না। আর তাদের পথ ধরে একের পর আরেক ব্যবসায়ী গ্রুপ তাদের প্রতিষ্ঠান খুলতে চাচ্ছে। আর সর্বশেষ ঈদকে সামনে রেখে দোকান মালিক সমিতি চাপ দিচ্ছে তাদের দোকান ও হাটবাজার খুলে দেবার। অন্যদিকে আরেক চিহ্নিত গ্রুপ পরিবহন মালিকরাও এই সুযোগে চাচ্ছে পরিবহন চলাচলের সুযোগ দিতে।  এর ভয়াবহতা কি আমরা বুঝতে পারছি। তার বক্তব্য, গত নির্বাচনের আগে সব ব্যবসায়ীএক প্ল্যাটফর্মে এসে শেখ হাসিনাকে সমর্থন করেছিল, আর এটাকে পুঁজি করে তারা সরকারের ঘাড়ে চেপে বসতে চায়। তাকে বলি দেখেন, ব্যবসায়ীরা সমর্থন করেছে তাদের গরজ থেকে। শেখ হাসিনার কোনও প্রয়োজন ছিল না তাদের সমর্থন। কারণ, এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই তারেক রহমান, গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের পায়ের কাছে বসে থাকতো। তাদের অনেকে এখনও জামায়াতে ইসলামীকে টাকা দেয়, নিয়মিত টাকা পাঠায় তারেক রহমানকে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনাই ক্ষমতায় আসবেন, তাই চামড়া বাঁচাতে শেখ হাসিনার মঞ্চে এসেছিলেন। এদেরজমা খরচে নেওয়ার কোনও দরকার শেখ হাসিনার নেই।
এখন একটা বড় প্রশ্ন আসে, ঈদের আগে শপিং মল না খুললে ঈদের কেনাকাটা হবে কীভাবে? উৎসব হবে কীভাবে? এ বিষয়েবুদ্ধিদীপ্ত, মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত এক তরুণ খুবই চমৎকার একটা উদাহরণ সামনে আনলেন। তার বক্তব্য হলো, ১৯৭১ সালে আমরা কি শপিং করে ঈদ করেছিলাম? ভারতে শরণার্থী হিসেবে যে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল, সর্বোপরি মুক্তিযোদ্ধারা কি শপিং করে ঈদ করেছিল? ১৯৭১-এ আমাদের প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার ক্ষমতা আমাদের ছিল। বিশাল রাষ্ট্র ভারত আমাদের শরণার্থীদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। সব ধরনের সহায়তা তারা দিয়েছিল। আর এবার আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষকে আমাদের খাওয়াতে হচ্ছে। তার ওপরে এবারের শত্রু ১৯৭১-এর থেকে ভয়াবহ। কারণ এ অদৃশ্য এবং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনও হাতিয়ার আমাদের হাতে নেই। সারা পৃথিবীর হাতে নেই। পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করেছে। প্রতিদিন বাড়ছে তাদের মৃত্যুর মিছিল। কোথায় গিয়ে সে মৃত্যু থামবে কেউ জানে না। তাদের গর্বের নিউ ইয়র্ক সিটি এখন মৃত্যুপুরী। আর সেখানে আমাদের এই জনঘনত্বপূর্ণ দেশে এই বিপদ মাথায় নিয়ে আমাদের কি শপিং করে ঈদ করার কোনও মানসিকতা আছে! বরং ঘরে বসে স্রষ্টার কাছে ঈদের দিনে দেশের মানুষের এই বিপদের পরিত্রাণের জন্য নামাজ পড়বো। সচেতন মধ্যবিত্ত কিন্তু শপিংয়ের সপক্ষে নয়। কবি মারুফ রায়হান তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তিনি তার এক বান্ধবীকে ফোন করে বলছিলেন, শপিং করতে না পাবার জন্য তো দুঃখ করছিলে, এখন শপিংমল খুলেছে—শপিং-এ যাও। উত্তরে তার বান্ধবী বলেছেন, তুমি কি আমার মৃত্যু কামনা করো।
বাস্তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার করোনা মোকাবিলার ধরন পর্যালোচনা করলে বলা যায়, আগামী পনেরো থেকে বিশ দিন কঠোরভাবে লকডাউনটা মেইনটেন করলে সংক্রমণ কমে যেতো। মৃত্যুর সংখ্যাও কম থাকতো। দেশ ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা সচল করার পথে যেতে পারতো। তাতে বেশি মানুষও মারা যেতো না। এমনকি দেশের জিডিপিও ৫ পার্সেন্টের নিচে নামতো না। কীভাবে জিডিপি ৫ পার্সেন্ট থাকতো সে বিষয় অন্য একটা লেখায় লিখবো। এখানে শুধু বলবো, শেখ হাসিনার মাথা যেমন সবখানে উঁচু থাকে, এখানেও তিনি উঁচু মাথায় সিদ্ধান্ত নিন। আর সে সিদ্ধান্ত হোক, তার দরিদ্র মানুষকে ঘরে আটকে রেখে, তাদের কাছে খাবার পৌঁছে তাদেরকরোনার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা। কারণ, তিনি তো সব সময়ই বলেন, কার কত অর্থ আছে সেটা তার কাছে বড় নয়, তার কাছে বড় তার দেশের একজন সাধারণ মানুষ তাই তিনি যতই দরিদ্র হোন।
আশা করি, বরাবরের মতো শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন। তিনি তার মানুষ বাঁচাবেন। ঢাকাকে কোনোমতেই নিউ ইয়র্ক হবার পথে কেউ বা কোনও মহল ঠেলে দিক, এটা তিনি হতে দেবেন না।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

সংবাদটি পড়া হয়েছে 334 বার

যোগাযোগ

অফিসঃ-

উদ্যম-৬, লামাবাজার, সিলেট,

ফোনঃ 01727765557

voiceofsylhet19@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

সম্পাদক মন্ডলি

ভয়েস অফ সিলেট ডটকম কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।