সাকিল আহমেদঃ সিলেট নগরে ‘বড় ভাই’ ‘ছোট ভাই”দের প্রতাপ। প্রতিটি এলাকা এমনকি অলি-গলিতেও তাদের দাপট। বড় ভাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা। তার শেল্টারেই ছোট ভাইয়েরা খুন, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ সবধরনের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। ছোট ভাইদের বয়স সর্বোচ্চ ১৮ এর বেশি বয়সীর সংখ্যা খুব কম। তারা এলাকায় কেক কেটে গ্যাংও সৃষ্টি করেছে।আর কথিত বড় ভাইরা তাদের হাতে তুলে দেয় কলমের বদলে অস্ত্র!!!
আর এই গ্যাং তৈরির মাধ্যম্যে উঠতি বয়সী স্কুল, কলেজ পড়ুয়া কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর অপরাধে।নগরীর পাড়া-মহল্লায় বেড়ে উঠে উঠতি মাস্তানদের উৎপাত। তুচ্ছ ঘটনায় দলেবলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির হয় এই উঠতি বয়সী তরুণরা। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সক্রিয় এসকল উঠতি বয়সী এসব কিশোর অপরাধীরা। তাদের হাতেই উঠে আসছে ঝকঝকে চকচকে অস্ত্রশস্ত্র। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের সন্তানরা পা বাড়াচ্ছে এ অন্ধকার জগতে। নগরীর পাড়া-মহল্লায় কিশোরদের মারামারি ঘটনা এখন নিত্যদিনের। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে পড়ছে নৃশংস খুনাখুনিতে।আর ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক নেতাদের শেল্টারের দাপিয়ে বেড়ায় পুরো এলাকা।
এইতো গত বুধবার সামান্য “জুতা” নিয়ে বাকবিতন্ডায় সিলেট কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভিতরেই সহপাঠীদের হাতে খুন হয় তানভীর আহমেদ তুহিন নামে এক শিক্ষার্থীর।সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় ৮/১০ জন কিশোর কাঠের টুকরা,স্টিক,নান চাকু নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তানভীরের উপর।প্রাণ বাচাঁতে তানভীর পালাতে চেষ্টা কালে তাকে উদ্দেশ্য করে স্টিক ছুড়ে মারে পরক্ষনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তানভীর।সিলেট ওসমানীতে মেডিকেল এ নেওয়া হইয় তাকে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যায় তানভীর। কীভাবে এই তরুণ বয়সের ছেলেরা এত নিষ্ঠুর হল যে, আরেকটি কিশোরকে তারা মেরেই ফেলল? কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের সমাজ? কীভাবে এত বেশি নিষ্ঠুরতা দেখা দিচ্ছে তরুণদের মধ্যে?
তরুণ বয়সীরা এমন কিছু দেখছে বা শিখছে যা তাদের এত বেশি নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে দিচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ রোধ করতে প্রয়োজন আইনের কঠোর শাসন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বড় ধরনের অপরাধ করেও ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অনেক অপরাধী। একটি অপরাধের যদি যথাযথ বিচার ও অপরাধীর শাস্তি না হয় তখন দশজন নতুন অপরাধীর জন্ম হয়। আজ যদি তানভীরের খুনের বিচার না হয়, খুনিরা যদি আইনের ফাঁক ফোকড় দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে বেরিয়ে যায় তাহলে আরও অনেক তানভীরের মৃত্যুর পথ পরিষ্কার হবে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, নগরীতে যেসব নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে এর সবকটির সঙ্গেই জড়িত রয়েছে উঠতি মাস্তানরা। বিশেষ করে সরাসরি যারা কিলিং মিশনেও থাকছে উঠতি সন্ত্রাসী। এদের যন্ত্রণায় সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। উঠতি মাস্তানদের মধ্যে অনেকেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অপরিচিত মুখ। ফলে তাদের গ্রেফতারে সফল হচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।তাছাড়া গত ৫ বছরে সিলেট নগরীতে হত্যাকান্ড ছাড়াও যেসব আলোচিত ঘটনা হয়েছে এর বেশিরভাগই ঘটিয়েছে উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীরা। তারা মহল্লা কেন্দ্রিক তৈরি হয়েছে ছোট বড় অপরাধী গ্রুপ। এসব উঠতি বয়সীদের শেল্টার দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা।কিশোরদের গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ‘বড়ভাই’রা। এই কথিত ‘বড়ভাইরা’ সন্ত্রাসী। কিশোরদের তারাই নিয়ে যায় বিপথে। দেয় নিষ্ঠুরতা, মারামারি ও অপরাধের তালিম।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সজাগ ও তৎপর হত তাহলে কিন্তু এই সব গ্যাং, বড়ভাইদের দাপট কোনো কিছুই থাকত না। প্রাণ দিতে হত না তানভীরের মতো কিশোরদের।
উঠতি বয়সী বা টিনএজাররা নিজেদের মনে করে হিরো।এইসব ছেলেদের দেখলেই চেনা যায়। তাদের চুলের স্টাইল অন্যরকম। কখনও স্পাইক করা, কখনও-বা পিছনে ঝুঁটি বাঁধা। হাতে ব্যান্ড, গলায় চেইন। কিন্তু এরা তো ‘বড়ভাইদের’ হাতের পুতুল। কারা নিয়ে যাচ্ছে এদের বিপথে, কারা সেই সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা?
আর কী কারণে, কোন মোহে পড়ে এই তরুনরা সন্ত্রাসী ‘বড়ভাই’এর কথায় ওঠে-বসে?
এটা হল তেল মেরে ‘হিরো’ হওয়ার মোহ। ‘বিনাকষ্টে’ প্রতিষ্ঠা, মোটরসাইকেল চালানো, সালাম পাওয়া, গার্লফ্রেন্ডের চোখে হিরো হওয়ার মোহ। যখন একজন কিশোর দেখে সারা বছর পড়ালেখা করে যা রেজাল্ট হচ্ছে তার চেয়ে বড়ভাইদের হুকুম তামিল করে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পেয়ে বেশি ভালো রেজাল্ট হচ্ছে, তখন আর সে কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙতে চায় না। সে চায় লিফটে উঠতে। এক লাফে শীর্ষে পৌঁছুতে।
তানভীরের মতো কিশোরদের খুন হওয়া থেকে এবং অন্যদের খুনি হওয়া থেকে বাঁচাতে সবচেয়ে আগে কঠোর ভূমিকায় যেতে হবে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। পাড়ায় মহল্লায় এইসব গ্যাং গ্রুপ,দলবেঁধে অশালীন মন্তব্য করা, মোটরসাইকেলে বেপরোয়া ঘুরে বেড়ানো কিশোর তরুণদের দেখলেই পুলিশের উচিত এদের সতর্ক করা, থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা, এবং অভিভাবকদের ডেকে পাঠানো। গার্লস স্কুল কলেজের সামনে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোকে কয়েকবার থানায় নিয়ে ডিটেনশন দিলেই এগুলোর মাথা থেকে ‘হিরো’ হবার খায়েশ পালাবে।
সেই সঙ্গে ‘বড়ভাই’দের গ্রেপ্তার করা দরকার তাদের ‘রাজনৈতিক প্রভাবের’ কথা বিবেচনা না করে। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাদের ওই বিষাক্ত বাঁশি ভেঙে ফেলা দরকার অবিলম্বে।
আর পরিবারেরও কিছু ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। বাবা-মায়েরা খেয়াল রাখুন আপনার সন্তান কীভাবে বড় হচ্ছে, কার সঙ্গে চলাফেরা করছে। সে কোন আদর্শ নিয়ে বড় হচ্ছে সেটাও খেয়াল করুন। এলাকার ‘বড় ভাই’দের খপ্পরে পড়ার আগেই আপনি তার দিকে মনোযোগ দিন।নিজের জীবনে যে মূল্যবোধ মেনে চলেন সেটাই সন্তানকে শিখান। অনেকে এসব ক্ষেত্রে শুধু মায়ের উদাহরণ টানেন। কিন্তু সন্তানের জন্য বাবা-মা দুজনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে তারা এই মাস্তান গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে ‘বড়ভাই’দের পাশার ঘুঁটিতে পরিণত হবে না।তানভীরের মতো আর কোনো কিশোরকে অকালে প্রাণ দিতে হবে না, আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না। কিশোরদের কোমল চেহারা হয়ে উঠবে না খুনি দানবের বীভৎস অবয়ব।