লবীব আহমদ
আজ “শিক্ষক দিবস”।
সত্যিই খুব মনে পড়ে পিতৃতুল্য শিক্ষক ও মাতৃতুল্যা শিক্ষিকাগণকে। জন্ম নেওয়ার পর থেকে বেড়ে উঠা পরিবারে। পরিবারের সদস্যগণ যথাসাধ্য শিক্ষা দিয়ে এক্কেবারে শৈশবটুকু কাটিয়ে দিয়েছে। শিক্ষকের মর্যাদা বোঝা যায় না , নিজে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই জায়গায় পৌছুনো হয়। সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মান ও মর্যাদাশালী পেশা হচ্ছে শিক্ষা।
আমি যখন একটু ভালো বুঝতে শিখি, তখনি শুরু হয় মসজিদের মক্তব জীবন। সেখানে প্রতিদিন ভোরে যাওয়া, সূরা-ক্বেরাত পড়া।
তারপর যখন আরেকটু বড় হই, তখনি ভর্তি হই আল ফয়েজ প্রিয় ক্যাডেট একাডেমীতে। সেখানেই স্কুল জীবনের ক্লাস শুরু। প্রতিদিন সকাল সকাল উঠতে হত ঘুম থেকে। বড়বোন আর আমি সকালে রেডি হয়েই আমাদের গ্রামের বড় রোডে যেতাম, তারপর সেখান থেকে স্কুলের গাড়ি এসে নিয়ে যেত। স্কুলটির তখনকার অবস্থানটি ছিল কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের পাশে। প্রতিদিন সেখানে যেতাম আবার ২ টায় ছুটি হলে গাড়ি এসে দিয়ে যেত। এভাবে একবছর সেখানে কাটালাম। আর নার্সারি ও উত্তীর্ণ হলাম। অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। সেখানকার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মোশাররফ হুজুর।
তারপর ভর্তি হলাম সেখানে, যেখানে আমার মামা পড়াতেন সিলেট কদমতলী মাদ্রাসায়। তখন উনার সাথে আমিও চলে যাই উনার মাদ্রাসায়। সবারি ইচ্ছে পরিবারের বড় ছেলেকে মোল্লা বানাবেন। সেখানে একবছর পড়ার পর সেখান থেকে মামা বদলী হওয়ায় আমিও চলে আসি।
স্ট্যান্ডার্ড টু তে ভর্তি হই শিবের বাজার আল ফালাহ ইসলামী একাডেমীতে। এখানে তখন আমার মামা চাকুরী করেন। তাই, উনার সাথেই সেখানে যাওয়া।
ছোট থেকেই আমার গলায় টনসিলের সমস্যা ছিলো। তাই, বারবার গলা ফুলে যেত। তখন ২০০৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট সিটি পলি ক্লিনিকে প্রথম গলায় অপারেশন করানো হয়। সেই সাথে আমি আল ফালাহ থেকে চলে আসি আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। তখন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নুরুল ওয়াহিদ স্যার। স্যার হলেও সম্পর্কে নানা হওয়ায় আমি নানা বলেই ডাকতাম। সব থেকে বেশি মায়া করতেন আমাকেই। প্রচুর গল্প করতেন। তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিলাম। আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যেত দুপুর ১২টায়। যোহরের নামাজ পড়ার জন্য নানা স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে আসতেন মসজিদে। আমাদের বাড়ির পাশে মসজিদ থাকায় আমিও দুপুরে নামাজে যেতাম। তখন আমাকে দেখিয়ে ঐ ছাত্রদেরকে বলতেন, ‘দেখো আমার নাতি স্বেচ্ছায় নামাজে এসেছে। অথচ তোমাদের মেরে নিয়ে আসতে হয়। একদিন সে অনেক বড় হবে’। এ কথাগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। সত্যি জীবনে কিছু পাইবা না পাই শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোবাসা আর দোয়া পেয়েছি।
দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে যখন তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হই, তখন উনার অনুভূতি দেখেছি। কেননা – আমি প্রথম সাময়িক পরীক্ষা না দিয়েই দ্বিতীয় হয়েছি। যেখানে বছরের তিনটি পরীক্ষার রেজাল্ট মিলিয়ে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হয়, আর আমি একটা না দিয়েই দ্বিতীয়। কিন্তু, নানার সেই ভালোবাসা টুকু আর পাই নি। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠতেই তিনি বদলি হয়ে চলে গেলেন পূর্ণাছগাম প্রাইমারি স্কুলে।
তৃতীয় শ্রেণিতে উঠতেই প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যুক্ত হলেন অনিল চন্দ্র শর্মা স্যার। তখন আমাদের ক্লাসে ছিলো না স্যারের কোনো বিষয়। স্যারকে নিয়ে আমরা অনেক হাসাহাসি করতাম। কিন্তু, তিনিই শেষ পর্যন্ত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একজন শিক্ষকে পরিণত হন।
তখন পুরাতনদের মধ্য ছিলেন দেবল চন্দ্র তালুকদার স্যার ও অঞ্জনা রায় ম্যাডাম। লেখাপড়ায় ভালো থাকায় এবং আমার বোন এই স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ায় সবাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তারপর যখন পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলাম, তখন পড়াশুনার চাপ বেড়ে গেল। প্রথম শর্ত স্কুল কখনো মিস করা যাবে না। ক্লাসের ফার্স্ট বয় হওয়ায় চাপটা আমার ক্ষেত্রেই বেশি। তখন আমাদের ইংরেজি পড়াতেন দেবল চন্দ্র তালুকদার স্যার, গণিত পড়াতেন আনোয়ারা ম্যাডাম, বাংলা প্রথমে অঞ্জনা ম্যাডাম এবং পরে তিনি স্কুল থেকে বদলি হওয়ায় হেড স্যার অনিল চন্দ্র শর্মা পড়াতেন, বিজ্ঞান পড়াতেন সাদিয়া মাহবুব ম্যাডাম, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় পড়াতেন প্রতিমা ম্যাডাম ও ইসলাম শিক্ষা পড়াতেন সেনোয়ারা ম্যাডাম।
খুব কষ্ট হয় প্রিয় সাদিয়া ম্যাডামের জন্য। আজ আর আমাদের মধ্য নেই প্রিয় সাদিয়া ম্যাডাম। খুব মায়া করতেন সবাইকে। মায়ের মতন আদর পেয়েছিলাম ম্যাডামের কাছ থেকে। নিজের সবকিছু পরিবারের সদস্যদের মত শেয়ার করতেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যখন ম্যাডাম মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন, তখন উনাকে দেখতে যাই। উনি দেখেই চিনে ফেললেন আমি যে লবীব। প্রায় ৭ বছর পর দেখা হওয়ার পর ও আমাকে ভুললেন না। সত্যি জীবনে কিছু পাই বা না পাই সকল শিক্ষক-শিক্ষিকার ভালোবাসা পেয়েছি। উনি উনার মাকে বলতে লাগলেন আমার স্কুল লাইফের স্মৃতি গুলো। একদিকে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন আর অন্যদিকে আমার গুণগুলো বলতেই আছেন উনার মাকে। সত্যি, সেদিন নিজেকে নিয়ে একটু গর্ব হয়েছিল। আর ম্যাডাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া ও করেছিলেন। তাদের দোয়ার কারণে আজো আমি জয়ের পথে আছি।
সমাপনী পরীক্ষা দেওয়ার পর যখন সোনার বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন আলাদা মায়া পাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মুনিম স্যারের কাছ থেকে। পরে আরো ভালোবাসায় জড়িয়ে নেন নুরুল হক স্যার, মোল্লা স্যার জনাব ওলিউর রহমান। আলাদা একটা ভালোবাসা পেয়েছিলাম সহকারী প্রধান শিক্ষক আতিকুর রহমান স্যারের কাছ থেকে। গণিতের শিক্ষক সোহেল স্যারের কাছ থেকে ও পেয়েছি ভালোবাসা। আর প্রদ্যুথ চক্রবর্তী স্যারের ক্লাসে ফাকি দেওয়ার কারণে তিনি মামু বলে সম্বোধন করতেন। আরো উল্লেখ্যযোগ্য স্যার হলেন কফিল মাহমুদ, সামসুল হক, সামসুল ইসলাম, মোশাররফ হোসেন, আহসানুল হক, শুভাস দাস, মুস্তাক আহমদ, দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।
জেএসসিতে যখন ৪.৭৫ পাই, তখন দেখি আমাকে নিয়ে স্যারদের আফসোস। তারাও আমাকে নিয়ে আশা করেছিলেন এ প্লাসের।
এসএসসি পাশ করে যখন স্কুল থেকে চলে আসি, সত্যি খুব কষ্ট লাগছিলো। স্যারদের কথা ভাবতেই চোখে জল আসতে লাগলো।
তারপর ভর্তি হই ইমরান আহমদ কারিগরি কলেজে। সেখানে প্রথমে পাই ৫জন স্যার। পরবর্তীতে আরো ৩জন যোগ হন। খুবি বন্ধুসুলভ স্যারদের পেয়েছি কলেজ জীবনে। যেকোনো কিছু স্যাররা আমাদের সাথে শেয়ার করতেন, আমরা ও মন স্বাধীন শেয়ার করতে পারতাম সকল সমস্যা গুলো।
আসলে কলেজে এসে বুঝতে পারি স্যারদের মায়া ও ভালোবাসা। প্রতিটা স্যারের কাছেই প্রিয় একজন ছাত্র আমি লবীব। এ ভালোবাসার দাম হাজার জীবনেও দিতে পারবো না। প্রচুর বিশ্বাস স্যারদের আমার উপর। রেজাল্ট খারাপ হলেই সব স্যারের কাছ থেকেই শুনতে হয় লম্বা লম্বা লেকচার। যেকোনো কাজে পুরো ভরসা রাখেন আমার উপর। আমিও আমার যথাসাধ্য তাদের ভরসা রাখার চেষ্টা করি।
যখন হতাশ হয়ে পড়ি, তখন স্যারদের ভালোবাসা আর উপদেশ আমাকে জাগিয়ে তুলে।
কলেজ জীবনে স্যার হিসেবে পেয়েছি প্রিন্সিপ্যাল রুহুল আমিন স্যার, ভাইস প্রিন্সিপ্যাল কামাল হোসেন স্যার, আনোয়ার হোসেন স্যার, হেলাল আহমদ স্যার, শাহিনুর আলম স্যার, বশিরুল ইসলাম স্যার, কয়েছ আহমদ স্যার, রায়হান হোসাইন স্যার, দেলোয়ার মনির স্যার ও শাহিন খান স্যার প্রমুখ।
আসলে জীবন খুবি ক্ষণস্থায়ী। আর এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে আমাদের কাজ আমাদের কে আজীবন স্মরণীয় করে তুলে। শিক্ষক হচ্ছেন মা-বাবার পরে সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপ্ত ব্যক্তি। শিক্ষক আমাদের খারাপ-ভালো সম্পর্কে শিক্ষা দেন। নয়তো আমরা জীবনে কোনো কিছুই করতে পারতাম না। শিক্ষক কোনো কিছু বললে, তাঁর সাথে তর্ক করা উচিত নয়।
তাই, জীবনে সজ্ঞানে থাকা অবস্থায় কখনো শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি করা উচিত নয়। শিক্ষক যদি কোনো আদেশ করেন, তাহলে অবশ্যই এতে ভালো কোনো কিছু আছে। আবার-যখন কোনো কিছু নিষেধ করেন, সেহেতু সেখানে খারাপ কোনো কিছু আছে।
শিক্ষককে অবশ্যই সম্মান করা উচিত। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম বলেছিলেন, “তিনজন লোকই পারেন একটি সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করে গড়ে তুলতে”। তাই, মানুষ গঠনে শিক্ষা এবং শিক্ষকের বিকল্প নেই।