নিউজ ডেস্ক:-
চোখে না-দেখা এক ভাইরাস কী নিদারুণভাবে আমাদের চোখ খুলে দিল! অদৃশ্য কোনো কিছুকেই বিশ্বাসের চৌহদ্দীর মধ্যে আনতে চায় না যে মানুষগুলো, তারাও অদেখা করোনার ভয়ে কেমন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার চাঁদর মুড়ি দিয়ে গৃহবন্দী! বলছি না, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা মানুষগুলো বিশ্বাসের পথে যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু তাদের অবিশ্বাসের “অন্ধ-বৃত্তে” টোকা পড়েছে সন্দেহ নেই। অবিশ্বাসীদের কোনো আশ্রয় থাকে না। কিন্তু চরম বিপদে মানুষ আশ্রয় খোঁজে। ফেরআউন নীলনদে ডুবতে ডুবতে যেমন আশ্রয় চেয়েছিল মুসার রবের কাছে। এই জায়গায় অবিশ্বাসীরা একধাপ পিছিয়ে! শেষ পর্যন্ত তাদের অবিশ্বাস আর অসহায়ত্ব একাকার হয়ে যায় অসীম শুন্যতায় কিংবা নীলনদের গভীর জলে!
সে থাক, আমরা বরং কথা বলি বিশ্বাসীদের নিয়ে। সেখানেও করোনার অবদান অনেক। সম্ভবত এই প্রথম পৃথিবীর এতো মানুষকে একসঙ্গে মৃত্যুর ভয় পাইয়ে দিয়েছে কোভিড ১৯ নামের এই ভাইরাসটি।
যেন মৃত্যুর বিষয়টি করোনার কারণেই মানুষের মনে পড়ল! মৃত্যুর মতো এতো অবধারিত অনিবার্য ঘটনাকে আমরা কী অবলীলায় ভুলে গিয়েছিলাম, উপেক্ষা করেছিলাম! প্রতিদিন কাউকে না কাউকে মরতে দেখেছি, তবু ভাবিনি এইবার বোধ হয় আমার পালা। ধরেই নিয়েছি মৃত্যুর বিষয়টি ঠিক আমার জন্য নয়, বা আমার এখনো সময় হয়নি। করোনা এসে দেখিয়ে দিল, মৃত্যু সবার! ভয়ে পুরো পৃথিবী গর্তে ঢুকে গেল। তৈরি হলো সামাজিক দূরত্বের বয়ান। ‘অসামাজিক’ মানুষের এখন শুধু একটাই প্রত্যাশা, এইবার যেন বেঁচে যাই। যেন আগামিকালই শোনা যায়, পৃথিবী করোনামুক্ত। আবার জীবন যাপন স্বাভাবিক হোক। শুরু হোক সামাজিক নৈকট্য। করোনাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভয়ের নাম। অথচ করোনা ছাড়াও মানুষ মরে। দু’তিন দিন আগেই, যেদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে নয় জন মানুষ মারা গিয়েছিল, সেই দিনই কয়েক ঘণ্টায় সারাদেশে বজ্রপাতে মারা গেছে ১১ জন! গড়ে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৫ জনের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। করোনাই মৃত্যুর একমাত্র কারণ নয়! করোনা এসে শুধু মনে করিয়ে দিল, আমরা মৃত্যুকে কতো ‘অপশনাল’ ধরে নিয়েছি! আমরা কতো বেশি মৃত্যু-ভয়হীন জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি! করোনা সেই ‘ডেসপারেট’ জীবন যাপনের বিপরীতে এক বড় ‘রিমাইন্ডার।’
এবং এটির সাংঘাতিক প্রয়োজন ছিল। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, অহংকার, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, বৈষম্য, অমানবিকতা যেভাবে পৃথিবীর প্রতিটি ভূ-খণ্ডে বিস্তার লাভ করছিল, একটা ‘পস’ অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। করোনা এসে যেন সেই হুকুমটিই দিল, ‘ব্যস, এবার থামো!’ আর কী অসহায়ভাবেই না আমরা অদৃশ্য এই ভাইরাসের কাছে হেরে গেলাম! আমরা থেমে গেলাম। থেমে যেতে বাধ্য হলাম। সিরিয়ার আকাশে যুদ্ধবিমান থেমে গেল। ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন থেমে গেল। কাশ্মীরে ভারতীয় আধিপত্য থমকে গেল। আমেরিকার বারগুলো বন্ধ হলো। দম্ভ ভরে কথা বলা মন্ত্রীরা কোয়ারেন্টাইনে চলে গেল। মুখের কথায় সিংগাপুর, মালয়েশিয়া হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের করুণ দশা আরো উন্মোচিত হলো। করোনা আমাদেরকে দেখিয়ে দিল অনেক কিছু।
আমরা তো জানি, আমাদের গন্তব্য ঠিক হয়ে আছে। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও গন্তব্যের ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। আজ নয়তো কাল। করোনার কারণে আমাদের মনগুলো নরম হলো। সেই নরম মনেই আমরা শুরু করতে পারি নতুন উপলব্ধির চাষ। আমরা আর একটু ভালো হই। আর একটু বিনয়ী। আর একটু নিরহংকারী। আর একটু মানবিক। আর একটু অনুগত হই করোনার স্রষ্টার প্রতি। এবং এই সুযোগটি আরো বেশি করে এলো পবিত্র রমজানের কারণে। করোনা এমনিতেই সবাইকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। রোজার দিনগুলোতে গৃহবন্দী এই সময়টুকু হতে পারে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার উপলক্ষ। রমজান যে কারণে মহিমান্বিত, সেই কুরআন অধ্যয়নের সুযোগ যাদের এতোদিন হয়নি, এবার তার মোক্ষম সময়। আরো নানা ইতিবাচক কাজে লাগানো যায় সময়গুলো। সবকিছুর মূলে যেন থাকে এক রূপান্তরিত জীবনের গল্প। করোনার আগের জীবন ও করোনার পরের জীবন। নিশ্চয়ই করোনা থেমে যাবে। পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হবে। আবার শুরু হবে মানুষের নিত্য পথ চলা। কিন্তু সেই চলা যেন আগের মতো উদাসীন উন্মত্ত বেহিসেবী না হয়। করোনার পরের জীবন হোক অনুগত এক জীবন, প্রস্তুতির এক জীবন।
অদৃশ্য করোনা আমাদেরকে চক্ষুষ্মান করুক। আতংকে জবাব নেই, মুক্তিও নেই। আতংকিত না হয়ে সময়টা কাজে লাগাই প্রস্তুতিতে; জীবনের এবং পরবর্তী জীবনের!
লেখক: রফিক রুমান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক