শেখ রিদওয়ান হোসাইনঃরাতের ঘুমন্ত শহরে পেট্রোল পাম্প স্টেশনে পাহারা দিতেন গুলজার আহমদ। জীবন শব্দটাকে লড়াই হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে সংগ্রাম করেই কাটতো তার জীবন। হামিদা আওয়ান নামের এক তরুণীকে জীবনসঙ্গী করে হয়েছেন পাঁচ সন্তানের পিতাও। যার মধ্যে একজন হয়ে উঠেছিলেন ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’! সেই নাইট ওয়াচম্যানের ঘরে আলো দেখেছিলো ‘বিশ্বের সর্বকালের সেরা’ দ্রুতগতির বোলার।
১৩ আগস্ট ১৯৭৫ সালে শোয়েব আখতারের জন্ম। সারাবিশ্বে যার একটি নামেই পরিচিতি,’ফাস্টেস্ট বোলার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড’। বাল্যকালে একজন ভালো ছাত্রের তকমা নিয়েই বেড়ে উঠেছিলেন শোয়েব। তারপর আসগর মল কলেজে ভর্তি হলেন পড়ালেখার ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখার জন্য।
কিন্তু সেটি আর হয় নি!লাহোরে অনুষ্টিত, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস ক্রিকেটের একটি ট্রায়ালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি সারলেন।পরিবারের সবাই বললেন,কোথায় যাচ্ছো আখতার? উত্তরে তিনি বললেন,আমি জানিনা। কিন্তু লাহোরে যাবার মত হাতে তো বাস ভাড়াও ছিলো না তার। শূণ্য হাতটুকু স্বপ্ন পূরণে এতটুকু বাঁধাও দিতে পারে নি। বাসের অপেক্ষা করে সেই বাসের হেল্পারকে অনেক ম্যানেজ করে বাসের ছাঁদে চড়েই রওয়ানা হলেন ‘ইতিহাস লিখার গল্পে’।
পাকিস্তানের একটি বিখ্যাত টিভি শো’তে এসে নিজের বিখ্যাত হওয়ার পিছনের গল্প এভাবে উপস্থাপন করেন শোয়েব,” আমার ক্যারিয়ারে অসংখ্য সংগ্রাম রয়েছে। আমি রাস্তায় ছিলাম স্মার্ট,স্কুলের ভালো ছাত্র কিন্তু জীবন সম্পর্কে এতো খুব খেয়াল আমার ছিলো না যে আমি কি করবো। আমি খুব অস্বাভাবিক ছিলাম সেটা হোক কলেজে বা অন্য কোথাও। আমি যে কোনো কিছুর মুখোমুখি দাঁড়াতাম এবং আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে আসতাম। আর আমি যে অঞ্চলে বাস করতাম সেখানে প্রচুর হিংসুটে ব্যাক্তি ছিলো। কারণ আপনি যখন খুব দ্রুত এগিয়ে যাবেন তখন এসবের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এটি ভালোই, যাতে আপনি আরও ভাল করতে পারেন।”
পাকিস্তানের তৎকালীন অবকাঠামো সম্পর্কেও তিনি বলেছেন যে ”তখনকার সময়ে অনেকগুলো স্টেডিয়াম থাকলেও,উপযুক্ত অবকাঠামোর বড্ড অভাব ছিলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা ফাঁকা পকেটে থাকা আমার জন্য খুবই কষ্টের ছিলো। পাঞ্জাবি একটি উক্তি আছে,যখন আপনি ক্ষুধার্ত থাকবেন,তখন আপনার পকেটে টাকা থাকবেনা। আর যখন আপনার পকেটে টাকা থাকবে,তখন আপনার ক্ষুধার অনূভুতিটা হবে না।”
কথাগুলো কিন্তু বাস্তবিক অক্ষরেই সত্য। একজন শোয়েব আখতার হওয়া কোনো একরাত্রির মিরাকল তো নয়। সংগ্রাম করতে করতে আর প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি নিয়েই শোয়েব আখতার তৈরি হয় বিশ্বের ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখানোর জন্য। তার মুখ থেকেই শুনি তার ফাস্ট বোলার হয়ে উঠার গল্প। যে গল্পটি তিনি ওয়াসিম আকরামকে শুনিয়েছিলেন-
“সত্যি বলতে প্রথমে আমি আপনাকে দেখেছিলাম, পরে ইমরান(ইমরান খান) ভাইকে আর তারপর ওয়াকার ইউনুসকে। তারপর আমি চিন্তা করলাম,আমি আপনাদের ৩ জনকেই নকল করি যাতে করে আমি ভিন্ন কিছু হতে পারি। কখনো আমি আপনার বোলিং এ্যাকশন নকল করতাম আবার কখনও ওয়াকারের মুখ ঢাকা হাতটি।
ওয়াকারের মুখ ঢাকা হাত নিয়ে শোয়েব আরোও বলেন,”আমি ওয়াকারকে দেখতাম সে তার ছোটো আঙুলটি লুকিয়ে রাখে মুখ ঢাকার সময়। তাই একদিন উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাকে যে কেনো হাতটি পুরোপুরি উন্মুক্ত করেন না? উনি খুব ভদ্রতার সাথেই বললেন যে,তার বাম হাতের ছোটো আঙুলটি নেই।এটি শোনার পর যখনই আমি তার ভঙ্গিটি নকল করতাম,তখন বুঝতাম, অনুপ্রেরণা ও বীর দুটোই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এখানে কোনো বীর থাকে না,তাহলে সেখানে কোনো অনুপ্রেরণাই নেই।”
শোয়েব আখতার সবসময়ই একটু ঘাড়ত্যাড়া টাইপের ছিলেন। তার এই বিদ্রোহী মনোভাবের পিছনেও ছিলো কিছু তিক্ত সত্যির বাস্তবিক কারণ। শোয়েবের গল্পে তার জেদ ও বিদ্রোহী ভাবের কারণ তিনি সেরাদের মতোই ব্যাখা করেছেন,
“আমার জীবনটি শুরুই হয় ‘না’ দিয়ে। তুমি এটা করতে পারবে না,ওটা করতে পারবে না,তুমি বড় কিছু হতে পারবে না,তোমার তো কোনো টাকা নেই,না না না আর না। এই ‘না’ ই সর্বশেষে আমার পার্সোনালিটির অংশ হয়ে জুড়ে রয়,আমার বিদ্রোহী ভাবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি যা কিছু করতে চাইতাম,শুরুটা হতো ‘না’ দিয়ে। তুমি একজন ফাস্ট বোলার হয়ে উঠতে পারবে ‘না’, কিন্তু আমি হয়ে দেখিয়েছি।
তো যখন শোয়েব পিআইবির ট্রায়ালে লাহোরে গিয়েছিলেন, তারপর কি হয়েছিলো? শোয়েব ট্রায়ালে গিয়ে দেখতে পান ৫০০০ হাজার খেলোয়াড় যারা ট্রায়াল দেওয়ার জন্যই এসেছে। তখন চিন্তায় পড়ে যান কিভাবে ট্রায়ালে সুযোগটি পেতে হবে। ঠিক তখন জহির আব্বাসকে তিনি দেখতে পেলেন কিন্তু তাকে কিভাবে মুগ্ধ করতে হবে তার কোনো আইডিয়া ছিলো না।
তারপর তরুণ শোয়েব কোনো কারণ ছাড়াই দৌড়াতে লাগলেন আর যখন জহির আব্বাসের কাছে এলেন,তখন নিজেকে শো অফ করতে শুরু করলেন। এভাবে ৫ বার রাউন্ড করে দৌড়িয়ে করতে থাকায় জহির আব্বাস তাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই তুমি কে? আখতার বললেন,আমি খুব দ্রুতগতির বোলার, আমাকে একটি সুযোগ দিয়ে দেখুন। জহির আব্বাস রাজি হয়ে বললেন,ওকে দেখি তুমি কি করতে পারো,যাও বোলিং করো।
এই মহা সুযোগ কি আর স্বপ্নে বিভোর সেই তরুণ ছেড়ে দিবে? ৫০ গজের রান-আপ নিয়ে দূর্ধর্ষ বাউন্সার ছাড়লো ঠিক ব্যাটসম্যানের মাথা বরাবর যা হেলমেট থাকায় কোনমতে ব্যাটসম্যান রক্ষা পেয়ে গেলো। দ্বিতীয় বল আরোও ভয়ংকর ছিলো যা ব্যাটসম্যানের যা সোজা ব্যাটসম্যানের পাঁজরে আঘাত হানলো। নিরুপায় ব্যাটসম্যান শোয়েবকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তার ছাপঁ তখন স্পষ্ট। জহির আব্বাস উদ্বেলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,কে এই পাগল বোলার? সেখানে থাকা কোনো এক ব্যাক্তি বললেন,এ তো দেখি রাওয়ালপিন্ডি থেকে উঠে আসা আরেক পাগল!
সেখান থেকে শোয়েব আখতারকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। পাকিস্তান ক্রিকেটে বড় নামের একটি নাম হয়ে গেলেন ‘শোয়েব আখতার’। পরিচিত হলেন ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ নামে। কেউ কেউ ‘টাইগার’ নামেও তাকে ডাকতো।
শোয়েব আখতারের ক্যারিয়ার খুব বেশি দীর্ঘ হতে পারেনি বার বার ইঞ্জুরি আর বিতর্কিত কিছু কর্মকান্ডের জন্য। ৪৬ টেস্ট খেলে তার উইকেট সংখ্যা ১৭৮ টি। বোলিং গড় ছিলো ২৫.৬৯। যদি না ইঞ্জুরির থাবায় বার বার আক্রান্ত হতেন,নিশ্চিত ভাবেই টেস্টে অসংখ্য রেকর্ড ভেঙে দিতেন। ওয়ানডেতে তো আরোও ভয়ংকর ছিলেন তিনি। ১৬৩ ম্যাচ খেলে ২৪.৯৭ গড়ে তুলেছেন ২৪৭ টি উইকেট।
১৯৯৯ সাল থেকে মূলত আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার উজ্জ্বল হতে থাকে।তখন তার সবচেয়ে দামি পারফরম্যান্স ছিলো ইন্ডিয়ার কলকাতায় অনুষ্টিত এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপে ৮ উইকেট তুলে নেন। শচীনকে করা নিজের প্রথম বলেই আউট করে দেন তিনি।
টেস্টে ২ বার একই ম্যাচে ১০ উইকেটের দেখা পেয়েছেন, আর দুটিই এসেছিলো ২০০৩ সালে। একটি ছিলো পাকিস্তানের মাটিতেই বাংলাদেশের বিপক্ষে আর অন্যটি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে তাদেরই বিপক্ষে।
১০০ মাইল ব্যারিয়ারে বল করা বিশ্বের প্রথম বোলার শোয়েব আখতার। যার রেকর্ড ১৬১.৩ কি.মি/ঘন্টায় বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম বল হিসেবে স্বীকৃত। অসংখ্য বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের তার ক্ষিপ্র গতি দিয়ে ভয়ে কাঁপিয়েছেন। বিধ্বংসী সব বাউন্সারে কখনো কারো ফাটিয়েছেন মাথা,অথবা নাক। কোনো এক সাক্ষাৎকারে শোয়েব বলেছিলেন, “ইউ হেভ টু বি এ ম্যাড,টু বি এ ফাস্ট বোলার”।
সত্যিই তো,ফাস্ট বোলাররা পাগলাটে না হলে তাকে ফাস্ট বোলার মনেই হয় না। ক্রিকেটে নতুন এক মাত্রা সৃষ্টি করেছিলেন তার ক্রেজি সব ভঙ্গি দিয়ে। যা এখনকার ফাস্ট বোলারদের মধ্যে একটুও দেখা যায় না।
ভালো থাকবেন শোয়েব আখতার।আমাদের ছোটোবেলা রাঙিয়ে দেওয়ার পিছনে তোমারও অবদান ছিলো।তৎকালীন সময়ে এমনকি এখনও বাংলাদেশের কোনো প্রান্তেই কেউ জোরে বল করলে উপাধি পায় ‘শোয়েব আখতার’।