আব্দুল কাদের তাপাদার:-
কিভাবে শুরু করবো ভাবছিলাম। লাখো শোকাহত ফেইসবুকার, সহকর্মী,সহপাঠী, বন্ধু, স্বজনদের মতো আমারও হাত কাঁপছিলো বার বার। আমারও বুকজুড়ে কষ্ট আর নীল বেদনা। কলেজ জীবনে কিছুকাল ঘনিষ্ঠতার সেই স্মৃতি কাতরতা এসে ভর করেছে। এমসি কলেজের প্রিয়ভাজন মেধাবী মঈন উদ্দিনের (পরবর্তীতে নামকরা জনপ্রিয় ডাক্তার) চেহারা যেনো বার বার ভেসে উঠছিল। নিজের কান্না থামাতে পারছিলাম না দিনভর।
সিলেট অঞ্চলে একালের সর্বাধিক জনপ্রিয় এক মানবতাবাদী চিকিৎসক ডাঃ মঈন উদ্দিনের মরণের খবরে মঙ্গলবার ভোর থেকেই শোকে মাতম দেশের সোস্যাল মিডিয়া। সহপাঠী, সহকর্মী, শিক্ষার্থীসহ হাজারো একটিভিস্টদের একের পর এক স্ট্যাটাসে সোস্যাল মিডিয়ায় যেনো কারবালার শোক বইছে। শোক ছাপিয়ে ক্ষোভ আর প্রতিবাদেও ভাইরাল সোস্যাল মিডিয়া।
ফেইসবুকের একেকটি স্ট্যাটাস যেনো শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে আমাদের। কারো কারো লেখার স্মৃতিচারণ পড়ে চোখের জলে ভাসছে লাখো মানুষ। হৃদয়বিদারী ভাষায় কেউ কেউ ডাঃ মঈন উদ্দিনের মানবতাবাদী জীবনের নানা খন্ডচিত্র তুলে ধরেছেন।
কয়েকটি অনেক লাইন পোর্টাল তার মৃত্যুর আগপিছ ঘটনার আদ্যপান্ত বিবরণ দিয়ে সিলেটে চিকিৎসার অবহেলা আর রাস্ট্রের চরম উদাসীনতা, নিষ্ঠুরতার অভিযোগ তুলেছে। ধীরে ধীরে শোকের মাতম ছাপিয়ে ক্ষোভ আর প্রতিবাদে ভাইরাল হয়ে উঠেছে সোস্যাল মিডিয়া। সাম্প্রতিক কালে কোনো একজন মানুষের মৃত্যুতে এমন শোকের মাতম, এমন ক্ষোভ আর প্রতিবাদ দেখেনি সোস্যাল মিডিয়া কিংবা অনলাইন গণমাধ্যম।
নঈম নিজাম:
দেশের জনপ্রিয় দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক, প্রখ্যাত সাংবাদিক নঈম নিজাম তার
ফেইসবুক আইডিতে এই মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি না করার আহবান জানিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন- বড় অদ্ভুত এক সমাজে বাস করি। একদল প্রশ্ন করছেন ডা. মঈন কোন ধারার রাজনীতি করতেন? আমার পাল্টা প্রশ্ন আপনারা কোন আসমানের মানুষ? বাস্তবতা আপনাদের কানে যায় না? দম্ভ ছাড়ুন। মাটিতে পা রাখুন এবার।
ড. মইন করোনা যুদ্ধের প্রথম শহীদ। নষ্ট রাজনীতি বন্ধ করুন। একজন চিকিৎসক জীবন দিয়েছেন। তাকে সম্মাণ দিন। শ্রদ্ধা জানান। বর্তমান বাস্তবতা মোকাবেলা করতে হবে মানবতাকে সামনে রেখে। ভন্ডামি মার্কা রাজনীতি দিয়ে নয়। মইন ঢাকা আসতে আইসিউ অ্যাম্বুলেন্স পাননি। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাননি। পারলে সেই সব নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করুন।
মাশরাফি বিন মুর্তজা:
‘সবাইকে শোকে ভাসিয়ে চলে গেলেন এক মহৎ প্রাণ ডাক্তার! করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গতকাল সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মানবিক ডা. মো. মঈন উদ্দিন চলে গেলেন না ফেরার দেশে! তিনি ছিলেন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা। তাঁর এই মৃত্যু হৃদয় বিদীর্ণ করার মত।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ছোবলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও আক্রান্ত। দেশের এই মহাক্রান্তিকালে ডা. মঈন উদ্দিন ছিলেন দেশের মানুষের জন্য আত্মোৎসর্গীকৃত। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন মানবসেবী হিসেবে মানুষের সেবা করে গেছেন তিনি। নিজের জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে তিনি চিকিৎসাসেবা দিয়ে গেছেন।
মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি তার এই আত্মত্যাগ শব্দ-বাক্যে প্রকাশের মত নয়। মানবতার জয়গান গাওয়া ক্রান্তিকালের এই যোদ্ধাকে নিশ্চয় গোটা জাতি আজীবন পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে।
আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। সবশেষে আমি এই বীরযোদ্ধাকে জানাচ্ছি- ‘স্যালুট’।’
সানজিদা মেহনাজ:
সিরিয়ার সেই শিশুটির মতো আমিও আজ বলে গেলাম “আমি আমার আল্লাহকে সব বলে দেবো” তুমি বললে, আমি নাকি পিপিই’র অজুহাতে কাজ করতে চাই না, বিশ্বাস করো, আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছি। আমি শুধু আমার রোগীদের স্বার্থে নিজের নিরাপত্তা চেয়েছি। তুমি বললে, চেম্বার খোলা রাখতে। আমি নিজে এবং অন্য রোগী আক্রান্ত হবো জেনেও তোমার কথা মেনে নিলাম। যার ফলে আজ আমার এই পরিণতি ।
তুমি বললে আক্রান্ত হলে সব দায়িত্ব তোমার। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সিলেটে যখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলাম, তখন আমাকে ঢাকায় নেওয়ার জন্য তুমি এয়ার এ্যাম্বুলেন্স কিংবা আইসিইউ এ্যাম্বুলেন্স দাও নি। আমাকে নিজের উদ্যোগে ঢাকায় আসতে হয়েছে। তুমি বললে তোমার প্রস্তুতি উন্নত দেশের চেয়েও ব্যাপক। আজ নিজের প্রাণ দিয়ে বুঝলাম এ শুধু ফাঁকা বুলি। আজ এই কয়দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে আমি হেরে গেলাম। আমি তোমার মত করোনার চেয়ে শক্তিশালী নই।
বিশ্বাস করো, আমি প্রণোদনা চাই নি, আমি আমার সুরক্ষা চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, আমি কাজের স্বীকৃতি চাইনি, আমি বেঁচে থাকার অধিকার চেয়েছিলাম। এখন বুঝলাম এখানে বেঁচে থাকার চাওয়াটুকু অনেক বড় চাওয়া।
এখানে তুমি আক্রান্ত হওয়ার আগে তোমার নিরাপত্তার নামে তামাশা হবে। (পিপিই হবে পিপিপি আর এন ৯৫ মাস্ক হবে কাপড়ের মাস্ক আর প্রস্তুতি হবে শতভাগ)। এখানে তুমি আক্রান্ত হলে তোমার দায়িত্ব তোমার কর্তৃপক্ষ নিবে না। আর তোমার মৃত্যুর পর তুমি হয়ে যাবে মৃত্যুর মিছিলে একটি সংখ্যা।
ডা: ফয়জুর রহমান: (মরহুমের ছাত্র)
স্মৃতিকাতর হয়েছেন তার লেখায়। বলেছেন, স্মৃতি খুব কষ্টের, মঈন স্যারের ইন্টার্ন ছিলাম, ইন্টার্নশিপ শেষ হলে স্যার যে হাসপাতালে চেম্বার করতেন ঐ হাসপাতালে ডিউটি ডক্টর ছিলাম। একদিন রাত ২টায় এক রোগী ভর্তি হলো প্রচন্ড খিচুনি নিয়ে। রিসিভ করেই স্যারকে ফোন দিলাম, স্যার ফোন ধরেই বললেন ‘ফজলুর আমিতো প্রায় বাসায় চলে আসছি, ম্যানেজ করতে পারবা না?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, স্যার ডায়াজিপাম দিয়েছি, রোগীটা খারাপ এখনও খিচুনি হচ্ছে দেখে গেলে ভালো হত স্যার। স্যার ওভার ফোনে কি কি করতে হবে কিছুক্ষণ বললেন, তারপর হঠাৎ বলে বসলেন ঠিক আছে ফজলুর তুমি ফোন রাখ আমি আসছি।’
দশ মিনিটের ভিতরে স্যার চলে আসলেন। এসেই বললেন যেহেতু ডায়াজিপাম দিয়ে ফেলেছো এখন আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নেক্সট স্টেপে যেতে হবে, স্যার ১৫ মিনিট রোগীর পাশে অপেক্ষা করলেন তারপর বললেন, এখন ফসফেন লোডিং শুরু করো। রোগিটা গরিব ছিল স্যার নিজে থেকে যাবতীয় পরীক্ষার ৫০% কমানোর জন্য স্লিপে সাইন করলেন।
পরে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন শোন, ‘পার্টি গরীব, আমার ভিজিট তোলার দরকার নাই, ফ্রী করে দিও আর সকালে পেশেন্ট স্টেবল হলে ওসমানীতে রেফার্ড করে দিও, আজ আমার ইউনিটে ভর্তি আছে, এখানে এরা হসপিটালের বিল দিতে পারবে না’। এই ছিলেন আমাদের মঈন স্যার।
আসুন মেডিসিনে FCPS ও কার্ডিওলজিতে MD করা এই ডাক্তারকে আমাদের রাষ্ট্র কি দিয়েছে দেখি, করোনাতে আক্রান্ত হয়ে স্যার যখন শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন সিলেটে, একসময় ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য স্যার এই রাষ্ট্রের কাছে একটি এয়ার এম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে স্যার এয়ার এম্বুলেন্স পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না, আমার সদা হাস্যজ্বল স্যার তারপর অনুনয় করে রাষ্ট্রের কাছে একটি আইসিউ এম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র কর্নপাতই করেনি।
অবশেষে স্যার নিজ উদ্যোগে একটি সাধারণ এম্বুলেন্সে কুর্মিটোলা হাসপাতালে রেফার হলেন এবং আজ সকালে রাষ্ট্রকে সকল দায়ভার থেকে মুক্তি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। নাহ, রাষ্ট্র কিছুই হারায়নি শুধু আমরা চিকিৎসকরা হারিয়েছি এফসিপিএস ও এমডি কমপ্লিট করা মানবিক একজন স্যারকে।
আজ কিছুই বলতে চাই না:
ফেসবুকে জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক মো. হাই লিখেছেন, আজ কিছুই বলতে চাই না। বলতে চাইনা সিলেটের করোনা রোগীর জন্য তৈরি হাসপাতালটির কথা। বলতে চাই না অস্থায়ীভাবে নিয়ে আসা দুটি আইসিইউ ভেন্টিলেটর এর কথা। বলতে চাইনা ঢাকায় যাওয়ার জন্য তার পরিবারের অসহায়ত্বের কথা। আজ শুধু বলতে চাই ডাক্তার মইন আর আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেনা। নিজে চিকিৎসক হয়েও নিজের চিকিৎসার জন্য হাহাকার করতে হবে না। তার মৃত্যু আমাদের এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি সাইনবোর্ড। আমরা চিকিৎসকরা নিজেরাও অপরাধী। তার জন্য মূলত আমরা কিছুই করতে পারিনি।’’
ডা. মো.জহিরুল ইসলাম:
প্রখ্যাত চুক্ষ রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো.জহিরুল ইসলাম লিখেছেন,“বেচে থাকার প্রচেষ্টায় মঈন শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনাকে যথোপযুক্ত মনে করেননি। নিজের কর্মস্থল ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউ এর দিকে তাকিয়েছিলেন, জুটেনি। ঢাকায় যাবেন- এয়ার অ্যম্বুলেন্স কর্তৃপক্ষ দেননি, কারন তিনি এতোটা প্রটোকালধারী ব্যক্তি নন। সরকারী ব্যবস্থাপনায় আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সও কপালে জুটলো না। বেঁচে থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় একটা বেসরকারী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে তিনি ঢাকায় গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে উনার ফুসফুসের যে ক্ষতি হলো তা আর পুনরুদ্ধার করা গেলো না।
অবশেষে তিনি সৃষ্টিকর্তার আহবানে সাড়া দিয়ে চলেই গেলেন। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে আবারো বলছি শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের করোনা ব্যবস্থাপনা ডা. মঈন তাঁর নিজের জন্য উপযুক্ত মনে করেননি, এটা কোন করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত নয়। যতই ঢাক ঢোল পিটিয়ে এর ব্যবস্থাপনা উপযুক্ত বলা হোক না কেন আমরা কনভিন্সড নই।”
ডা. জাকির সুমন:
বিএসএমএমইউর চিকিৎসক জাকির সুমন লিখেছেন, ‘আমাদের ক্ষমা করবেন স্যার। আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন স্যার। কারণ এমন দেশে চিকিৎসক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন যে দেশ আপনার জন্য হেলিকপ্টার বা সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে পারে নাই। তবে আপনিই জাতীয় বীর, আপনিই বীরযোদ্ধা, আপনিই সংশপ্তক,আপনি শহিদ।’
তুহিনুল হক তুহিন:
সংবাদকর্মী তুহিনুল হক তুহিন লিখেছেন, জিতে গেলেন ডা. মঈন, হেরে গেল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়…..। ভবিষৎ প্রজন্ম তোমাদের কাছে অনুরোধ তোমরা ডা. মঈন হও। কারণ তিনি করোনার কাছে করুনা চাননি! তবে যারা এই বীরকে মূল্যায়ন করেনি তাদের মতো অমানুষ হইওনা।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক ও শিক্ষার্থী ইচ্ছামানুষ রনি তার এগিয়ে চল পেইজে লিখেছেনঃ
অথচ রাষ্ট্র তাকে একটা অ্যাম্বুলেন্সও দিতে পারেনি!লিখতে ইচ্ছে করছিলো না। উনি তো চলেই গেছেন। কিন্তু আরো শত শত পোটেনশিয়াল ডা. মঈন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
করোনা সংক্রমণের পরে আমি মাস্ক বিষয়ক অনেকগুলো ভিডিও দেখেছি। সার্জিক্যাল মাস্ক, N95 বা PM2.5 রেস্পিরেটর থেকে শুরু করে সাধারণ কাপড়ের ব্যাগ দিয়ে বানিয়ে যেগুলো আমাদের দেশে রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে- সেগুলো নিয়েও। প্রথম কতকিছু জানলাম। করোনা ভাইরাসের সাইজ ১৩৫ ন্যানো মিটারের আশেপাশে। আশেপাশে বলার কারণ, মিউটেশনের ফলে কোভিড ১৯ এর সাইজেও পরিবর্তন পাওয়া গেছে।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যে গাউন পরতে হবে তার ক্লদিংসের একটা সেফটি স্ট্যান্ডার্ড আছে যেটা দিয়ে ভাইরাসটা ঢুকতে পারবে না। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব না মেনে কোনোরকম একটা বানিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন গার্মেন্টস তাদের ইচ্ছেমত তৈরি করছে। সেটাও অপ্রতুল। ফেস শিল্ডের সেফটি স্ট্যান্ডার্ড আছে। অবশ্য আমাদের দেশে গগলসই অনেক বেশি! আর ফেস শিল্ড! ফেস শিল্ড তো এখনও পলিথিনই এদেশে। সেফটি বুটস? বললে বলবে, আপনি ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন নাকি, মশাই?
তো ভাইরাসটার মত বেশিরভাগ অভিজ্ঞতা ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যেও নতুন। একদমই নতুন। দেশে ট্রেনিং বা গাইডলাইন নেই। যেখানে অটোক্লেভ সুবিধা আছে সেখানে পিপিই অটোক্লেভে দিয়ে পুনরায় ব্যবহার করছে। যেখানে নেই সেখানে গরম পানিতে ফুটিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউ বাসা থেকে পরেই যাচ্ছে। কেউ কাজ শেষে বাসায় এনে খুলে বয়েলিংয়ে দিচ্ছে।
অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ওয়ান টাইম ইউজের পর হাসপাতালে বা কর্মক্ষেত্রেই ডিসপোজ করাটাই স্ট্যান্ডার্ড। নিজেদের সিঙ্গাপুর দাবী করলেও আমরা জানি, দেশটা গরীব। বড়লোক দেশে হয়তো সোনাদানা চুরি করে। গরীব দেশ বলেই এদেশে চুরি করতে হয় চালের বস্তা।
সকালে দেখলাম, ডা. মঈন স্যার মারা গেছেন। একটু ফিরিস্তি দেই। উনি ৬ বছর এমবিবিএস পড়েছেন। ৫ বছর ধরে কার্ডিওলজিতে এমডি করেছেন। আরো ৫ বছর ধরে মেডিসিনে এফসিপিএস। এমডি-এফসিপিএস এ চান্স পেতে প্রিপারেশনের জন্যে কয়েক বছর লেগেছে নিশ্চয়ই। চান্স পাওয়ার পর দুই-চার-পাঁচ পার্সেন্ট রেগুলার পাশ করে। তার মানে কমপক্ষে ২০ টা বছর উনি চিকিৎসাবিদ্যা শেখার অধ্যাবসায়ে ব্যয় করেছেন। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা আর রাজধানীর নাম মুখস্ত করে বিসিএসও দিয়েছেন। ফলাফল? প্রশাসন বা অন্য ক্যাডারের কেউ অসুস্থ হলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স চলে যায় যেখানে সেখানে রাষ্ট্র তাকে স্রেফ একটা অ্যাম্বুলেন্স দেয়নি! তাকে অসুস্থ অবস্থায় একটা প্রাইভেট হাসপাতাল (ওয়েসিস) থেকে নিজে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় আসতে হয়েছে! আবার লিখছি, সরকার তাকে একটা অ্যাম্বুলেন্সও দেয়নি। যে সিলেটে তিনি চিকিৎসা দিয়ে একটা জীবন ব্যয় করলেন, কোভিড ১৯ পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টে পিছপা হলেন না, সেই সিলেট তাকে চিকিৎসা দেয়নি!
একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স চেয়েছিলেন ডা. মঈন, পাননি, লিখতে ইচ্ছে করছিলো না। উনি তো চলেই গেছেন। কিন্তু আরো শত শত পোটেনশিয়াল ডা. মঈন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। একজন ডেন্টিস্ট মারা গেছেন। একজন স্বাস্থ্যকর্মীও সম্ভবত। আমার এক স্যার বলতেন, ডাক্তার-নার্সরা স্টুডেন্ট লাইফ থেকে ইনফেকশনের মধ্যে থেকে অভ্যস্ত।
আশেপাশে মাল্টি ড্রাগ রেসিস্টেন্ট টিবির পেশেন্টও থাকে। তাও তারা সাধারণত ইনফেক্টেড হয় না। এই পরিবেশে কাজ করতে করতে অ্যাকুয়ারড ইমিউনিটি কিভাবে যেন ডেভলপ করে যায়। কিন্তু একবার যদি হয়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অটো ইনফেকশনের কারণে তাকে আর বাঁচানো যায় না। এটা খুবই সত্য। নির্মম সত্য।
যে কারণে মন খারাপ নিয়ে লিখলাম, হেলথ ওয়ার্কারদের মত আর কেউকে স্বেচ্ছায় রোগীদের এত ক্লোজ কনট্যাক্টে যেতে হচ্ছে না। শুধু ডাক্তার না, নার্স-ওয়ার্ড বয় সবার যেতে হচ্ছে। পুলিশ দাফনের দায়িত্ব নিয়েছে দেখলাম।
যদিও এখন পর্যন্ত মৃত্যুর পরে করোনা ছড়ানোর প্রমাণ মেলেনি। তারপরেও যাদের এত কাছাকাছি যেতে হচ্ছে তাদের সকলের জন্যে যেন সরকার মানসম্মত, আমি আবার লিখছি, সরকার যেন প্রোটোকল মেনে মানসম্মত প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করে। তা না হলে মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাবে না।
সংক্রমণের সম্ভাবনা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি, ধর্মান্ধদের চেয়েও। দেশে পঞ্চাশের বেশি চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত। স্বাস্থ্যকর্মী হিসাব করলে সংখ্যাটা অনেক বেশি হবার কথা। এগুলো এখনও স্রেফ সংখ্যা। এভাবে চললে এরপর পরিসংখ্যানে রূপ নেবে।
অনেকে করোনাকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করছেন, মিলিয়ে ফেলছেন। দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। মুক্তিযুদ্ধে সবাই অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলো। এটাতে পারবে না। সবাই অংশগ্রহণ করতে গেলে বরং সবাইকে মিলে মরতে হবে। রাস্ট্রের কাছে চাওয়া তো শুরু থেকে একটাই- মানসম্মত প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট।
মঈন স্যারের পরিবার তার মৃত্যু শোক সহ্য করার ক্ষমতা লাভ করুক। আরেকটা কথা, যারা তাকে বাঁচাতে পারেনি- স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিএমএ নেতারা, সিলেট থেকে ঢাকা, কেউ যেন তার মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি না করেন। আপনাদের ব্যর্থতা ঢাকতে একটা মৃত মানুষ নিয়ে রাজনীতি করবেন না।
বাংলা ট্রিবিউন :
জনপ্রিয় জাতীয় অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্টে মৃত্যুর জন্য ওসমানী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী
করা হয়েছে। শিরোনামসহ রিপোর্টের বিস্তারিত এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
নিজ কর্মস্থলেই চিকিৎসা পাননি ওসমানী মেডিকেলের ডা. মঈন
করোনাভাইরাস সঙ্কটে জনগণকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেই আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মঈন উদ্দিন। গত গত ৫ এপ্রিল তার শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর থেকে তিনি নিজের বাসায় কোয়ারেন্টিনে ছিলেন।
গত ৭ এপ্রিল রাতে অস্বাভাবিক শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় তাকে সিলেট সদর হাসপাতালের করোনা সেন্টারে আইসোলেশনে নেওয়া হয়। পরদিন আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হয় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।
কুর্মিটোলায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (১৫ এপ্রিল) ভোরে তিনি মারা যান। এদিকে, সিনিয়র এই চিকিৎসক নিজ কর্মস্থলসহ সিলেটে চিকিৎসা না পাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডা. মঈনের এক ছাত্রের বক্তব্য, “অক্সিজেনসহ স্যারের স্যাচুরেশন থাকে ৯০%। কিন্তু, অক্সিজেন ছাড়া ৮০%। এটা একটা খারাপ সাইন। ভেন্টিলেটর সাপোর্টের পূর্ব লক্ষণ। শামসুদ্দিনে ভেন্টিলেটর আছে। কিন্তু, মেইনটেইনেন্সের টিম (ডাক্তার, নার্স) নেই। যা ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। ওসমানীর ডাক্তারদের একাংশ স্যারকে সেখানে শিফট করতে চেয়েছিলেন। ওসমানীর এক ৪টি ভেন্টিলেটর আছে। কিন্তু, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তা নাকচ করে দেন ওসমানীর পরিচালক।”
অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, “এমতাবস্থায় মঈন স্যার ঢাকায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, এমন আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করোনা রোগী নেবে না। বিমান বাহিনীর একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে, সেটি ব্যবহার করতে হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সুপারিশ লাগে। এমতাবস্থায় মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সুপারিশ করতে অপরাগতার কথা জানান।”
“সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হয়েও তিনি পাননি নিজের প্রতিষ্ঠানের আইসিইউ, পাননি সরকারের অ্যাম্বুলেন্সও।” এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ১২০ বেডের আইসোলেশন সেন্টার খোলা হয়েছে।
গত ৪ মার্চ থেকে চালু হয়েছে এ আইসোলেশন সেন্টারের কার্যক্রম। এর বাইরে শাহী ঈদগাহ সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল এবং খাদিমনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলেও জানানো হয় মাসখানেক আগে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শামসুদ্দিন হাসপাতালে দুটি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) বেড কয়েকদিন আগে প্রস্তুত করা হয়।
তবে হাসপাতালের মধ্যে সন্দেহজনক রোগীদেরকে যে কক্ষে রাখা হয় (আইসোলেশন ইউনিট) তা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এখানে ভেন্টিলেন্টর থাকলেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন, সেন্ট্রাল এয়ারকুলারসহ কিছু সুবিধার ঘাটতি রয়েছে।
আইসিইউ’র শর্ত পূরণের জন্যে এসব সুবিধা অত্যন্ত প্রয়োজন। এছাড়া আইসিইউ পরিচালনার জন্যে শামসুদ্দিন হাসপাতালে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের মতো লোকবল নেই। বিষয়টি জেনেই করোনাভাইরাস আক্রান্ত চিকিৎসক মঈন উদ্দিনকে ওসমানী হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কয়েকজন চিকিৎসক।
এ প্রসঙ্গে ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমান বলেন, “ওসমানীর সবক’টি আইসিইউ বেড রোগীতে পরিপূর্ণ। পাশাপাশি হাসপাতালে প্রতিদিন সহস্রাধিক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এমন বাস্তবতায় ওই চিকিৎসককে সেখানে স্থানান্তর করা যায়নি।”
ওসমানী হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, “ওই চিকিৎসকের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কিংবা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাকে ঢাকায় স্থানান্তরের আবেদন জানায় তার পরিবার। কিন্তু ওসমানী থেকে তাকে কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি।”
কিন্তু এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ওসমানী হাসপাতালের পরিচালক বলেন, “হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সযোগে তাকে ঢাকায় পাঠাতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু, আইসিইউ সুবিধা না থাকায় বেসরকারি ওয়েসিস হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় পাঠানো হয়।” ইউনুছুর রহমানের দাবি, তারা ডা. মঈনকে সিলেটে রেখেই চিকিৎসা দিতে চেয়েছিলেন। পরিবারের সিদ্ধান্তেই তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক তরুণ সাংবাদিক এহসানুল হক জসিম তার আইডিতে লিখেছেনঃ
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই
ডা. মঈনের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী রাষ্ট্র। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, গরীবের ডাক্তার ও মানবিক চিকিৎসক হিসেবে সুপরিচিত ডা. মঈন উদ্দীন মারা যান ভেন্টিলেশন এর অপ্রতুলতা এবং পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে।
দেশের স্বার্থে এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে বাঁচানো দরকার ছিল। রাষ্ট্র তথা স্বাস্থ্য বিভাগ এখানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তুলনামূলক কম বয়সী এই ডাক্তার বেঁচে থাকলে হাজার হাজার মানুষ তাঁর কাছ থেকে চিকিৎসা সেবা পেয়ে উপকৃত হতো।
রাষ্ট্র বুঝতে পারেনি ডা. মঈনকে বাঁচানোর গুরুত্ব; অথবা বুঝেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তাঁকে যথাসময়ে ভেন্টিলেশনে নেওয়া হয়নি এবং হেলিকপ্টার বা এয়ার এম্বুলেন্সের সুবিদা দেয়নি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সময়মতো প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে বেঁচে যেতেন এই মেধাবী ডাক্তার।
ডা. মঈনকে যথাযথ চিকিৎসা এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত সুবিদা দেওয়ার ক্ষেত্রে গাফলতি ও ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদকে পদত্যাগের আহ্বান জানাই। এরা পদত্যাগ না করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি এদেরকে অপসারণ করুন